অনেক সময় মনের খুব কাছের, খুব চেনা কাউকে নিয়ে লেখার কাজটা মনের ভিতর মোটেও স্ফূর্তি আনেনা, বরং কাজটাকে করে দেয়; কিছুটা অস্বস্তিজনক। অনেক সময় আমাদের খুব চেনা কাউকে নিয়ে লিখতে বসলে হাতের পেনটা কাগজের উপর একই জায়গায় যেন স্থির হয়ে থাকে, এগোতেই চায়না। কিম্বা কখনো এমন পরিস্থিতিও হয় যেসময় হাজার কথার রাশি মনের ভিতর একটা জায়গাতেই ভিড় জমায় আর সেখানেই মারপিট জুড়ে দেয়। সেই অপ্রীতিকর মুহূর্তে অনেক কথাই নাবলা থেকে যায়। হয়তো বা যে কথা গুলো বলতে চাইছি, সেগুলো না বেরিয়ে অন্য কোন কথা বেরিয়ে পড়ে। অনেক কথার মাঝে আসল কথাগুলোই কেমন যেন হারিয়ে যায়। কাছেপিঠেই কোথাও থাকে; কিন্তু ঠিক সময়ে গাঢাকা দেয়। কিন্তু সামনে আসেনা।
সেই ছোট্টবেলা থেকেই সে আমার মনের অনেকখানি জুড়েছিল, এখনও আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে, সেটা আমি জানি। হয়তো জানার থেকে সেটাকে মানি বেশি, মন থেকে চাই বেশি করে যে সে যেন আজীবন এমনিভাবে আমার সাথে থাকে। ছোট্টবেলা থেকে তার নাম শুনলেই মনের ভিতরটা যে কেন হাজারটা হ্যালোজেন একসাথে জ্বলে উঠত, তার হিসেব এখনো জীবনের বেহিসেবীপনার খাতায় জমা আছে। এই একটা বিষয়ের অঙ্কটা মেলানোর সেভাবে চেষ্টাও করিনি কখনো। জীবনের কিছু কিছু অনুভুতিকে রহস্যজনক হিসেবে পেতে মন্দ লাগেনা। জীবনের চেনা ছকে পথ চলার সময় কানের পাশে সারাক্ষন একটা হিসেব না মেলা অঙ্কের চঞ্চল পায়ের আওয়াজ শুনতে বেশ একটা মাদকতা আসে। জীবনের পুরোটাই তো কেটে যাবে চলতি পথের সামনে পড়া গড়পড়তা অঙ্কগুলোর হিসেবের পিছনে ছুটে। তুমি ছুটতে না চাইলেও, জীবন তোমায় ছুটতে বাধ্য করবেই। কিছুটা ইচ্ছা, কিছুটা অনিচ্ছা মেশানো সেই ছোটার মাঝে বাধ্যবাধকতা তোমার হাত ধ’রে সামনের দিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবেই। তার চেয়ে মনের ভিতর নাহয় দু’-একটা এমন ইচ্ছে থাকনা যারা বেহিসেবীপনার মাদকতার পিছনে ছোটে।
আমার ছোট থেকে বেড়ে ওঠার মাঝের এক-একটা বছর শেষ হত তাকে নিয়ে...আবার শুরু হত বছরের শেষে তাকে দেখতে পাওয়ার উৎসাহকে মনের ভিতর সযত্নে বাঁচিয়ে রেখে। এখনো তার কাছে এসেই যেন আমার প্রকৃতিকে দেখার ষোলোকলা হয় পূর্ণ। তার কাছে এসে চোখের সামনেই যেন সারা বছরের বৃত্তটা শেষ হয়। মনের যত চাওয়াগুলো ছিল তারা ‘পাওয়া’ নামক সন্তুষ্টির অনেক কাছে পৌঁছায়। আমি ক্ষণে-ক্ষণে দেখতে পাই প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। আর চোখের সামনের এই বিশাল ক্যানভাসে ছবির রকম ফের হচ্ছে। কখনো ছবিতে ঔজ্বল্য বেশি কিন্তু রঙের মধ্যে আছে জলের ঘারতি, কখনো আবার জলের ঝাপটার তোড়ের সাথে যুদ্ধে; বেচারা রঙগুলো ঠিক এঁটে উঠতে পারছে না। ছবির এককোণে সব রঙগুলো তালগোল পাকিয়ে ভয়ে সিটিয়ে আছে...কিম্বা রঙে-জলে একাকার হয়ে সব রঙগুলো তাদের আসল রূপ হারিয়ে যেন কাক-চান করে সূর্য ওঠার অপেক্ষা করছে। আবার কখনো বা সিউলিফুলের কমলা-সাদার আধিক্যের মাঝে পড়ে আর পাঁচটা রঙ লুকোচুরিতে মন দিচ্ছে। কাছে পিঠেই থাকলেও, বদমাশগুলো যে ঠিক সময়ে কোথায় গা ঢাকা দেয়, তার খোঁজ নিতে কি এবার আমায় কাজ ফেলে তাদের নাম হেঁকে হেঁকে তাদের পিছনে ছুটতে হবে নাকি? মোটেও না। স্বভাবত কোথাও একটা অসম্পূর্ণতা থেকেই যায় প্রতিবার। এর মাঝের সময়কালীন ছবিটা এত বেশি স্পন্দনহীন, অর্থহীন হয়ে পড়ে যে, সাতটা রঙ আলাদাভাবে চিনতে পারা তো দূরের কথা রঙগুলো একে অপরের পাশে বসে সমস্বরে আমায় কি কথা যে বলতে চাইছে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে করতে কেটে যায় মাস খানেক। আর তখন রঙগুলোর গায়ে আরওবেশি করে হতাশা, প্রাণহীনতা, উচ্ছ্বাসের ঘারতি, মনখারাপেরা একে-একে জমা হতে থাকে। আমার আর রংগুলোর মাঝের ফারাকটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রতি বছর মনে হয় এই বুঝি সব রঙ একে-একে ধুয়ে মুঝে সাফ হয়ে গেল। আর ঠিক তখনই যেন প্রাণহীনতার কুয়াশা সরে সাত-সাতটা রঙ হেসে খেলে ওঠে। ঠিক যেমনভাবে ঘুম থেকে ওঠামাত্র চোখের সামনের ছবিটা অপরিষ্কার থাকে, একটু চোখ কচলালে পরিষ্কার হয়ে যায়; তেমনভাবে যেন প্রাণহীনতার কুয়াশা সরে চোখের সামনের রংগুলোয় পড়া ধূলো-বালিগুলোর ঝাড়পোছ হয়ে যায়। নিজের সবটুকু উজাড় করে চোখের সামনের ছবিটাকে হাজারটা রঙে রাঙিয়ে তোলে। তখন বুঝে যাই যে, সে এসে গেছে। এতো মাসের এতো অপেক্ষায় এক অনাবিল সার্থকতা ঢেলে দেয় ওই এক-একটা রঙ। বুঝতে পারি এই রঙের প্রতি অগাধ ভালবাসা থেকেই আমার মন তার সাথে এমন সখ্যতা পাতিয়েছে। ভালবাসার সাথে সে যেন অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে, অন্তত আমার চোখের সামনে তো সে এমনি ভাবেই এসে দাঁড়ায়। সে আমার সাধের ফাগুন, আমার লোক-সমাজের বসন্ত। এপৃথিবীতে প্রতিটা জিনিসেই ভালো-খারাপ; আলো-ছায়া চোখে পড়ে। জানি, আমার ফাগুনও সেই নিয়মের বাইরে নেই। তাই আমার পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি তার দোষগুলোকেও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। কিন্তু তার প্রতি ভালবাসা কোনকোন সময় পিছন থেকে এসে আমার চোখের উপর হাত রাখে। ভালবাসা জিনিসটাই বুঝি এমন, সব দেখে, সব শুনেও; কিভাবে শুধু ভালোতে ‘বাস’ করা যায় তার পরিকল্পনা চালায় সর্বক্ষণ। সব কিছুর মাঝে শুধুমাত্র ভালোলাগাগুলো খুঁটে-খুঁটে তুলে বাক্সবন্দী করে আর মন্দলাগাগুলোকে কাছে ঘেঁষতেই দেয়না। এমন ভাব করে তাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতি যেন কিছুটা বাধ্যতামূলক...আর পুরোটাই অনিচ্ছাকৃত।
আমি মনে ক’রি, ভালোবাসা বলতে শুধুমাত্র কোন একটা ফিল্মের সুন্দর সুন্দর foreign location-এ নাচা-গানা হতে পারেনা। বিষয়টা এতটাও হাল্কা নয়। বরং প্রতিটা ব্যক্তির আলাদা আলদা অনুভূতি-নির্ভর, ব্যক্তিগত তো বটেই। এক-একটা মানুষ তার ভালোবাসাকে যেভাবে দেখে বা দেখতে চায় সেভাবেই সে তার ছবিগুলোকে সাজায়। বাইরে থেকে তাদের সেই ‘দেখতে-পাওয়া’ ছবিগুলোর কল্পনাই করা যায় মাত্র। নিজের কল্পনাকে চোখের সামনে রেখে ইচ্ছে মতো ছবির কালো দিক গুলোর উপর আলো ফেলে তার উপর সব রকম রং বুলিয়ে ছবিটাকে রঙিন করে তোলা যায়। কিন্তু বাস্তবতার পথ দিয়ে খালি পায়ে যেযার নিজেকেই এগিয়ে চলতে হয়। সেখানে কালো রঙগুলোকে ‘আলো’ করে তোলার সুযোগ বড় কম। আরে ধূত, বাস্তব কি শুধুই দুঃখের নাকি? সেটা শুধুই দুখের বা শুধুই সুখের না...সবটাই শতকরার খেলা। তাই একটা বছরের নানা মাসের ভিতর বৈসাদৃশ্যের মতো ভালোবাসায় আছে ভিন্ন মেজাজের রঙ। তার ভিতর বসন্তের লাল পলাশের গান আমাদের সকলের ঘুমের মাঝের সেই রঙিন চলচিত্রটা, যাকে ছুঁতে ইচ্ছে করে।
খুঁজলে ভালোবাসার মধ্যে গোটা একটা বছরের সাতটা...না না বারোটা মেজাজকে খুঁজে পাওয়া যাবে। যেখানে ‘গ্রীষ্মের’ মতো রাগ যেমন আছে, তেমনি আবার আছে ‘বর্ষার’ মতো মাটি ভেজা কান্না। ‘শরতের’ পুজোপুজো আমেজের দমফাটা হইহুল্লোড় যেমন আছে তেমনই ‘হেমন্তের’ একাকী নিঃসঙ্গতাও আছে। আবার আছে ‘শীতের’ মতো জমাট বাঁধা অভিমান। সবকিছুর মাঝে যখন একটা ঝকঝকে তকতকে বিকেলে দুটো মানুষের প্রেম-প্রেম পায়; সেই ফরসা মুহূর্তে চারপাশটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেয় আমার আদরের ‘বসন্ত’। সেখানে সবকিছুই কেমন যেন কাল্পনিক, জেগে জেগেই মানুষের চোখে স্বপ্ন জুড়ে আসে। সেই কাল্পনিক ক্যানভাসের মালিক তুমি নিজে...তাই ছবি আঁকার তুলিটা তোমার হাতে। নিজের ইচ্ছে মতো ‘সুখ’টাকে রেখে বাকি ‘দুঃখে’র রঙগুলোর উপর জল ঢেলে দিয়ে ঝাপসা করে দেওয়াটা বুঝি একটা সর্বজনীন অভিপ্রায়। অন্তত একটা জায়গায় ‘কাঁচি’টা নিজের হাতে থাকলে সেটা চালাতে কে না চাইবে?
ভালোবাসার মিষ্টি দিকটাই বসন্ত। তাই বাস্তবতার ফ্যাকাসে সাদা-মাটা রঙগুলোকে বসন্তের রঙিন রঙে ডুবিয়ে একটা জীবন্ত ছবি আঁকতে সবারই ভালো লাগে। বাস্তবের রঙ যেমনই হোক তার মধ্যে ইচ্ছে মতো জল কমিয়ে-বাড়িয়ে তাকে পরিষ্কার বা ঝাপসা করা যায়না। তাবলে একটার পর একটা দিনে গোনাগাটা, বাছাই করা ক’টা রঙকে নিজের ঝোলার পুরে; সারাটা জীবন কাটানো সত্যিই বোকামোর। জীবনের প্রতিটা বছরেই বসন্ত আসবে, সে কিন্তু দাঁড়াবেনা কারও জন্য। তাই আমি বলি কি, সে যখন এসে দাঁড়াবে তোমার জানলার পাশে আর ঠকঠক করে পাল্লা খুলতে বলবে; তাকে ঘরের ভিতরে আসতে দিও। ফিরে যেতে দিওনা, কারণ একবার ফিরে গেলে আবার সেই গোটা একবছরের ধাক্কা। তার চেয়ে তাকে ঘরে ঢুকিয়ে যত্ন করে পাশে বসিও, আর তোমার প্রতিদিনকার একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যানে দিনগুলোর accelerator-এ চাপ দিয়ে; তোমার জীবনের গাড়িতে গতি এনো। আর তাকে সঙ্গে করে ঘুরে এসো কোন রঙ্গিন দেশে।
০৩ নভেম্বর - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪